পুলিশকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে স্থায়ী পুলিশ কমিশনসহ জাতীয় জননিরাপত্তা কমিশনের কথা ভাবছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পাশাপাশি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ সার্ভিসকে বিসিএসের বাইরে এনে আলাদা সার্ভিস কমিশনের অধীনে নেওয়া যায় কিনা, তা নিয়েও আলোচনা চলছে।গতকাল শনিবার হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনায় এমন মন্তব্য করেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য গোলাম রসুল। ‘৫৩ বছরেও পুলিশ কেন জনবান্ধব হতে পারেনি? পুলিশ সংস্কার কেন? কোন পথে?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশ বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংবাদিক ও নাগরিক প্রতিনিধিগণ।
আলোচনা সভায় গোলাম রসুল বলেন, ৩ মাসের মধ্যে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন সংস্কার করা সম্ভব নয়। কিছু বিষয় প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পুলিশে কী কী সংস্কার দরকার সে বিষয়ে জানতে চেয়ে আমরা অনলাইনে মতামত প্রদানের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। প্রায় ২৪ হাজার মানুষ তাদের মতামত জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই স্থায়ী পুলিশ কমিশন দাবি করেছেন। তিনি বলেন, কমিশন যে কয়েকটি প্রধান বিষয় বিবেচনা করছে এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে জাতীয় জননিরাপত্তা কমিশন। যেটি ২০০৭ সালের প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন থেকে মডিফাইয়ের মাধ্যমে করা হয়েছে এবং যার মধ্যে তিনটা প্রধান উপাদান থাকবে। এটি হবে একটি স্থায়ী কমিশন। এর একটি সচিবালয় থাকবে, থাকবে একটি গবেষণা সেল। রাজনীতিবিদ, আমলা, সিভিল সোসাইটি মিলে এই কমিশন গঠিত হবে। এই কমিশনের রেফারেন্স যেগুলো তৈরি করা হয়েছে সেগুলো আগের পুলিশ আইনের চেয়ে অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। তার মধ্যে প্রধান হলো বিদ্যমান আইন এবং নির্দেশিকাগুলো রিভিউ করা এবং সেগুলো পরিবর্তনের
জন্য সরকারের কাছে উপস্থাপন করা। গোলাম রসুল আরও বলেন, সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের অভিযোগÑ পুলিশ নিজেই নিজেদের তদন্ত করে যা সুষ্ঠু হয় না। সেজন্য এই কমিশনের অধীনেই আরেকটি সাব কমিটি থাকবে যেখানে সাধারণ মানুষ পুলিশ সম্পর্কে তাদের অভিযোগ দিতে পারবে। এই কমিশন স্বাধীন টিম করে অনুসন্ধান করবে এবং মূল কমিশন সেটি দেখভাল করবে।
শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ সার্ভিসকে আলাদা করার আলোচনাও হচ্ছে বলে জানান সংস্কার কমিশনের সদস্য গোলাম রসুল। বলেন, সব ক্যাডারের ভেতরে থেকে পুলিশের শৃঙ্খলার জায়গাটি বজায় রাখা কঠিন। আমাদের কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা বিচ্যুতির যে শাস্তি হয় তা ন্যূনতম। আবার আমাদের জুনিয়র সদস্যদের যে শাস্তি হয়, তাতে দেখা যাচ্ছে বছরে ২০০ লোকেরও চাকরি যায়। তাই আমরা ভাবছি পুরো পুলিশ সার্ভিসকে আলাদা একটি পুলিশ সর্ভিস কমিশনের অধীনে আনা যায় কিনা। যেখানে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর জেনারেল পর্যন্ত একটা সার্ভিসের অংশ হবে এবং এটিকে বিসিএসের বাইরে আনা যায় কিনা সেটা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এটার সমান্তরালে জননিরাপত্তা কমিশন গঠন করা গেলে এটির মাধ্যমে পুলিশের ওপর রাজনৈতিক কিংবা আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে বের করে আনা যাবে।
হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, পুলিশের তিনটি পরিচয় আছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, ডিসিপ্লিন ফোর্স আবার সিভিল ফোর্স। পুলিশকে বলা হয় ২৪ ঘণ্টার ভেতর তোমাকে কাজটা করতে হবে। কীভাবে করবে জানি না। এটি হলো পুলিশের মিলিটারাইজেশন করা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে তাদের এভাবে কাজ করার সুযোগ নেই। এই কালচার পুলিশে ঢুকে গেছে। পুলিশের সব কিছু ভেঙে পড়েছে। এর ফলে কী ক্ষতি হয়েছে সেটা সবাই দেখছেন। এজন্য পুলিশে সংস্কার জরুরি।
সাবেক ডিআইজি মেজবাউন নবী বলেন, আমরা মনে করি এটাই আমাদের শেষ সুযোগ। রাষ্ট্রীয় সংস্কার হোক বা পুলিশি সংস্কার, আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, ৫৩ বছর ধরে পুলিশ বাহিনীতে একটি খারাপ সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে পুলিশের মধ্যে এই মানসিকতা তৈরি করা হয়েছে যে, তাদের শাসককে রক্ষা করতে হবে। অতএব, সংস্কার যথেষ্ট নয়; পুলিশের মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, এর আগেও পুলিশ সংস্কারে আট থেকে নয়টি কমিশন হয়েছিল কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমান কমিশনের সংস্কারও আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমি সন্দিহান। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এটি সম্ভবও নয়। তিনি বলেন, আমাদের তিনটি আইনে পুলিশের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। পুলিশ ও আদালতের পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলোও সংস্কারের মধ্যে আনতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, আসলে আমরা সবাই অকৃতকার্য করেছি, পুলিশ একা নয়। নষ্ট লোকদের খুঁজে খুঁজে গত ১৬ বছর পদায়ন করা হতো। আমাদের দেখতে হবে আমরা সংস্কারের বিষয়ে উচ্চাকাক্সক্ষী হয়ে যাচ্ছি কিনা।আলোচনা সভায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কারে বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সৈয়দ আবদুল্লাহ বলেন, পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে বড় অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। চাকরি পেলেই সেই টাকা তুলতে চান তারা। নিয়োগের সময় ঘুষ প্রথা বন্ধ না হলে পরে সবসময়ই টাকা আদায়ের প্রবণতা থাকবে।ভারতের জাতীয় ফরেনসিক সায়েন্স বিশ^বিদ্যালয়ের পিএইচডি স্কলার মেরাজ হোসেন বলেন, আমাদের দেশে ফৌজদারি অপরাধ তদন্তে ডিজিটাল ফরেনসিক বিষয়ে আরও বেশি জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে ভালো মানের ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী জাকিয়া শিশির বলেন, পুলিশের খারাপ আচরণের কথা আমরা প্রতিনিয়ত শুনে থাকি। কিন্তু কেন এটা খারাপ? ৫৩ বছর ধরে আমরা এটা শুনে আসছি। পুলিশের অভ্যন্তরে এ নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে? আমাদের এই ক্ষেত্রগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমরা জনবান্ধব পুলিশ চাই।রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে মুক্ত আলোচনায় আরও বক্তব্য রাখেন, বিশিষ্ট দার্শনিক ও গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. আনিসুজ্জামান, আইসিটি ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির কো-অর্ডিনেটর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাজহারুল হক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ- এর কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মনির হোসাইন কাসেমী, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি ইয়াসমিন গফুর, ফ্রন্ট পেইজ সম্পাদক সেলিম খান, সাংবাদিক আহমেদ সেলিম রেজা, আইনের শিক্ষক ড. আহমেদুজ্জামান, হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. পারভেজ প্রমুখ।