‘সন্ত্রাসের জনপদ’ পঙ্কিসি ভ্যালি যেভাবে হয়ে উঠলো পর্যটন কেন্দ্র

আপলোড সময় : ০৯-০৬-২০২৫ ০২:২৭:২৩ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ০৯-০৬-২০২৫ ০২:২৭:২৩ অপরাহ্ন
একসময় সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল জর্জিয়ার পঙ্কিসি ভ্যালি। এখন সেই জায়গা রূপ নিয়েছে শান্তি, আতিথেয়তা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নতুন ঠিকানায়। কিস্ত সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে এখন পর্যটকরা মজে থাকছেন সুফি আচার আর লোকজ সংস্কৃতিতে। পাহাড়ি পথ মুগ্ধ করছে ভ্রমণপিপাসুদের মন, সঙ্গে মিলছে স্থানীয় খাবারের অপূর্ব স্বাদ।

পঙ্কিসির দুইসি নামের একটি ছোট গ্রামে প্রতি শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় ‘ধিকর’—একটি সুফি স্মরণানুষ্ঠান, যেখানে নারীরা নিজেদের আত্মাকে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে নেওয়ার চেষ্টায় মাতেন। আরবী ও চেচেন ভাষায় শান্তির গান গেয়ে, করতালির তালে আর ধীর ঘূর্ণনে তারা হয়ে ওঠেন সম্পূর্ণ তন্ময়। ককেশাস অঞ্চলে নারীদের পরিচালনায় এটিই একমাত্র ধিকর অনুষ্ঠান।

যেখানে একসময় পর্যটক তো দূরের কথা, কেউ যাওয়ার চিন্তাও করতো না—সেই পঙ্কিসিকে এক সময় বলা হতো ‘আইনহীন’ এলাকা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে হেডলাইন হতো সতর্কবার্তায়—এই অঞ্চল এড়িয়ে চলার পরামর্শ। কারণ, ২০০০ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা চেচেন উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল পঙ্কিসি। ছড়িয়ে পড়েছিল গুজব—এখানেই নাকি লুকিয়ে ছিলেন আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন!

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ও রাশিয়ার চাপের মুখে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালাতে বাধ্য হয় জর্জিয়া সরকার। কিন্তু স্থানীয় কিস্তদের দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর সামাজিক সমস্যাগুলো তখনও থেকে যায় আড়ালে।

এরপর অনেক চেচেন পরিবার পাড়ি জমায় ইউরোপে। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬—এই সময়ে কিছু তরুণ আইএসের আহ্বানে সিরিয়া চলে যায়। তাদের মধ্যেই ছিলেন আবু ওমর আল-শিশানি, যিনি পরে হয়ে ওঠেন আইএসের শীর্ষ নেতাদের একজন। ফলে আবারও শিরোনামে উঠে আসে পঙ্কিসি—এক ভয়ের নাম হয়ে।

কিন্তু বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। ২০২০ সালের এক ড্যানিশ অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টে বলা হয়—পঙ্কিসিতে অপরাধপ্রবণতা খুবই কম। এটি একটি শান্তিপূর্ণ এলাকা। স্থানীয়দের ভাষায়, “এখানকার পুলিশ চা খেয়েই দিন কাটায়।”

এখন পঙ্কিসির গল্প বদলে দিচ্ছেন এরই বাসিন্দারা। তারা পর্যটকদের আহ্বান জানাচ্ছেন—এসো, দেখো আমাদের সংস্কৃতি, জানো আমাদের জীবন। কেউ ঘোড়ায় চড়িয়ে পাহাড় দেখাচ্ছেন, কেউ গাইছেন লোকগান, কেউ বা হাতেকলমে শেখাচ্ছেন ডাম্পলিং বানানো।

এই পরিবর্তনের অগ্রদূত নাজি কুরাশভিলি। ২০১৩ সালে তিনি শুরু করেন ‘নাজিস গেস্টহাউস’। এরপর পর্যটন মন্ত্রণালয়কে রাজি করান—পঙ্কিসিকে পর্যটনের মানচিত্রে আনতে হবে। ২০১৮ সালে গঠন করেন ‘পঙ্কিসি ভ্যালি ট্যুরিজম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’।

আজ পঙ্কিসিতে রয়েছে ৯টি গেস্টহাউস—বেশিরভাগই দুইসি ও জোকোলো গ্রামে। অতিথিরা সেখানে পাচ্ছেন কিস্ত আতিথেয়তা, ঘরোয়া সুস্বাদু খাবার আর সংস্কৃতিমণ্ডিত অভিজ্ঞতা।

পঙ্কিসিতে ভ্রমণের উপযুক্ত সময় মে থেকে অক্টোবর। শীতকালে অনেক গেস্টহাউস বন্ধ থাকে, তবে কেউ এলে তাকে নিরাশ করা হয় না। তারা পাবে ঘোড়ায় চড়া, পাহাড়ি হাইকিং, সুফি ধিকর দেখা আর ঐতিহ্যবাহী রান্না শেখার সুযোগ।

কিস্ত রান্না হচ্ছে চেচেন ও জর্জিয়ান স্বাদের মিশ্রণ। সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে আছে—ঝিঝিগ গালনাশ (ডো আর ভেড়ার মাংসের ঝোল), আর খিনকালি (যেখানে মাংস নয়, ভরানো হয় লতাপাতা)। প্রতিটি উপকরণই আসে স্থানীয় উৎস থেকে—সবজি, দুধ, মধু, চিজ।

নাজির গেস্টহাউসে প্রতিরাতে বসে এক কমিউনাল ডিনার। অতিথিরা একসঙ্গে বসে খান, পান করেন গোলাপ ফল দিয়ে তৈরি ঘরোয়া বিয়ার, আর গল্পে গল্পে ভাগ করে নেন নিজেদের অভিজ্ঞতা—কেউ পাহাড়ে হাঁটার, কেউ ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার, কেউ বা ধিকর অনুষ্ঠানে মগ্নতার গল্প বলেন।

পঙ্কিসি ভ্যালি এখন আর শুধুই একটি পর্যটন গন্তব্য নয়। এটি এক সাহসী সম্প্রদায়ের গল্প, যারা প্রমাণ করেছে—ভয় আর ভুল ধারণাকে জয় করে গড়ে তোলা যায় এক শান্তিপূর্ণ, উষ্ণ আতিথেয়তায় ভরা সমাজ।

 


অফিস :

MyTv Bhaban, 155, 150/3, Hatirjheel, Dhaka-1219

Phone. ☎ +880255128896 ; Fax. +880255128899

Email. admin@mytvbd.tv