এর মধ্যে তিনি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন পাতাগোনিয়া, আন্দিজ পর্বতমালা, মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো ও পুরো যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়া হয়ে এশিয়ার কিছু অংশও পার করেছেন। কখনো মরুভূমি, কখনো গহিন জঙ্গল, আবার কখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের ভেতর দিয়ে অবিরাম হেঁটে চলেছেন এই অভিযাত্রী।বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসে একবার বেশ অদ্ভুত এক বাজি ধরেছিলেন কার্ল বুশবি—দক্ষিণ আমেরিকার শেষ প্রান্ত থেকে হেঁটে নিজের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরবেন তিনি! বুশবি তখন ২০ বছরের তরুণ। সেই বাজির কথা মনে করে তিনি বলেন, 'হঠাৎ বিষয়টা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। আলোচনা এগোতে থাকল। একসময় আমি হিসাব-নিকাশ করে দেখলাম, কাজটা আসলে করা সম্ভব। এরপর এই লক্ষ্য পূরণ করতে কী কী লাগবে, কীভাবে কী করব—এসব নিয়ে একরকম ঘোরের মধ্যেই পড়ে গেলাম।'
কয়েক বছর প্রস্তুতির পর ১৯৯৮ সালে চিলির পান্তা অ্যারেনাসে এসে দাঁড়ান বুশবি। তার নিজ শহর ইংল্যান্ডের হাল থেকে পায়ে হাঁটা পথের দূরত্ব হিসেবে এটাই সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দূরবর্তী জায়গা। সামনে প্রায় ৩১ হাজার মাইলের পথ। বুশবি ভেবেছিলেন, হেঁটে বাড়ি ফিরতে তাঁর হয়তো ১২ বছরের মতো সময় লাগবে।কিন্তু সেই ১২ বছরের জায়গায় কেটে গেছে ২৭ বছর। ৫৬ বছর বয়সী বুশবি এখনো হাঁটছেন। থামেননি।এর মধ্যে তিনি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন পাতাগোনিয়া, আন্দিজ পর্বতমালা, মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো ও পুরো যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়া হয়ে এশিয়ার কিছু অংশও পার করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম, প্রতিকূল আর রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত কিছু এলাকাও তাকে পার হতে হয়েছে। কখনো মরুভূমি, কখনো গহিন জঙ্গল, আবার কখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের ভেতর দিয়ে অবিরাম হেঁটে চলেছেন এই অভিযাত্রী।শুরুতেই নিজের জন্য দুটো কঠিন নিয়ম ঠিক করে নিয়েছিলেন বুশবি। গত ২৭ বছরে একবারের জন্যও সেই নিয়ম ভাঙেননি। নিয়ম দুটি হলো—সামনে এগোতে কোনো যানবাহনের সাহায্য নেওয়া যাবে না এবং হেঁটে গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বাড়ি ফেরা যাবে না।
বুশবি বলেন, 'কোথাও আটকে গেলে সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়েছে।'তখনকার দিনে পথ চিনে নেওয়া আজকের মতো সহজ ছিল না। অভিযানের শুরুর দিকের কথা মনে করে বুশবি বলেন, 'সে সময় ভরসা ছিল কেবল কাগজের মানচিত্র, পেনসিল আর ক্যালকুলেটর।বুশবি তার এই অভিযানের নাম দিয়েছেন 'গলিয়াৎ এক্সপিডিশন'। ভেবেছিলেন ১২ বছরেই শেষ হবে, কিন্তু নানা বাধায় সময় লেগেছে অনেক বেশি। কখনো অর্থের অভাব, কখনো ভিসার জটিলতা। এর মধ্যে ছিল রাজনৈতিক বাধা আর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। কোভিড মহামারির কারণেও অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ইংল্যান্ডের হাল শহরে নিজের বাড়িতে পৌঁছাবেন।
বুশবি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপার ছিলেন। সেখান থেকেই চ্যালেঞ্জ নেওয়া আর দেশভ্রমণের নেশা চাপে তার মাথায়। তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনীতে থাকার সুবাদে দারুণ সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্যারাট্রুপার হিসেবে ফিটনেস, সহনশীলতা আর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি সেখান থেকেই রপ্ত হয়েছে।'
সেনাবাহিনীতে থাকার সময় কয়েকজন বন্ধুকে হারান তিনি। এই মৃত্যু তাকে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তিনি বুঝতে পারেন, জীবন খুব ছোট। তাই যতদিন বাঁচবেন, সেরাটা দিয়েই বাঁচতে হবে।এসব ভাবনা থেকেই ২৯ বছর বয়সে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বুশবি। যদিও শুরুর দিকে কেউ তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। পকেটে মাত্র ৫০০ ডলার নিয়ে তিনি পথে নেমেছিলেন।বুশবি বলেন, 'শুরুতে আমার কোনো সহায়সম্বল ছিল না।' রাত কাটাতেন রাস্তার পাশে তাঁবু টাঙিয়ে। কখনো কখনো স্থানীয় কেউ আমন্ত্রণ জানালে তাঁদের বাড়িতে থাকার সুযোগ মিলত। আমেরিকা মহাদেশ পার হওয়ার সময়টা ছিল আক্ষরিক অর্থেই 'বেঁচে থাকার লড়াই'। এমনকি ক্ষুধা মেটাতে রাস্তার পাশ থেকে খাবার কুড়িয়েও খেতে হয়েছে তাঁকে।
তবে ধীরে ধীরে দিন বদলাতে শুরু করে। পরিবার থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা আসে। তার এই অবিশ্বাস্য অভিযানের কথা ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এগিয়ে আসে বিভিন্ন কোম্পানি। ২০০৩ সালে কানাডায় পৌঁছানোর পর তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বই প্রকাশের চুক্তি হয়। পরে একটি প্রযোজনা সংস্থা তাঁর এই যাত্রা নিয়ে সিনেমা বানানোর আগ্রহও দেখায়।বুশবি বলেন, 'এই অভিযানের বড় শিক্ষা হলো, কেউ আসলে একা কিছু করতে পারে না। রাস্তায় হয়তো আমি একাই হাঁটছি, কিন্তু আমার পেছনে বিশাল এক সমর্থন কাজ করছে, যা আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং এগিয়ে যেতে সাহস জোগায়।'
সহায়তা জুটলেও পথের বাধা কম ছিল না। পানামা ও কলম্বিয়ার মাঝে অবস্থিত 'ডারিয়েন গ্যাপ'ও পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বিশ্বের অন্যতম দুর্গম ও ভয়ংকর জঙ্গল হিসেবে কুখ্যাতি আছে এই জায়গার।২০০৬ সালে বুশবি আলাস্কা ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী বেরিং প্রণালিতে পৌঁছান। এটি ছিল তার যাত্রাপথের মাঝামাঝি। শীতে এই প্রণালি পুরোপুরি জমে বরফ হয় না। বুশবি বলেন, 'বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল ভাঙা বরফ আর সমুদ্রের পানি। সামান্য পথ এগোতেও বরফের চাঁই বেয়ে পার হতে হয়েছে।'আলাস্কায় এক দুঃসাহসী সঙ্গীকে নিয়ে তিনি এই প্রণালি পাড়ি দেন। বুশবি বলেন, 'কেউ বিশ্বাস করেনি আমরা এটা পারব। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রথম প্রচেষ্টাতেই আমরা সফল হই, যা কেউ ভাবেনি।'রাশিয়ায় ঢুকেই আরেক বিপত্তি। ভুল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করায় আটক হন বুশবি। ৫৭ দিন তাঁকে আটকে রাখা হয়, মুখোমুখি হতে হয় বিচারের। অবশেষে রুশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে হাঁটার অনুমতি দেয়। বুশবি বলেন, 'পুরো ব্যাপারটাই ছিল এক অলৌকিক ঘটনার মতো।'
দীর্ঘ এই যাত্রায় বাধার কোনো শেষ ছিল না। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় স্পনসররা সরে দাঁড়ালে থমকে যায় তার পথচলা। এরপর ২০১৩ সালে পুরোনো ভুলের জের ধরে রাশিয়া তাকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন বুশবি। নিষেধাজ্ঞা কাটাতে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে হেঁটে ওয়াশিংটনে রুশ দূতাবাসে গিয়ে আবেদন করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।২০২৪ সালের আগস্টে যাত্রাপথে দ্বিতীয়বারের মতো বড় জলাধারের মুখোমুখি হন বুশবি। রাজনৈতিক কারণে ইরান বা রাশিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই কাজাখস্তান থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত কাস্পিয়ান সাগর সাঁতরে পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। টানা ৩১ দিন ধরে তিনি সাঁতরেছেন। রাতে ঘুমাতেন সঙ্গে থাকা সহায়তাকারী নৌকায়।
তুরস্ক হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেন বুশবি। সম্প্রতি তিনি হাঙ্গেরিতে পৌঁছেছেন। নিজের শহর হাল থেকে আর মাত্র ৯৩২ মাইল (প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার) দূরে আছেন তিনি। বুশবি বলেন, 'পুরো পথটা আমাকে হেঁটে বা সাঁতরে পার হতে হয়েছে। যেখানেই থেমেছি, ফিরে এসে ঠিক সেখান থেকেই আবার যাত্রা শুরু করেছি।'ভিসার নিয়মের কারণে ইউরোপে একটানা ৯০ দিনের বেশি থাকতে পারেন না তিনি। তাই বাধ্য হয়ে বিরতি নিয়ে মেক্সিকোতে গিয়ে বিশ্রাম নেন। সময় হলে আবার ফিরে এসে সেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে হাঁটা শুরু করেন। তবে বয়সের কারণে হাঁটার গতি কিছুটা কমেছে। আগে দিনে ১৯ মাইল হাঁটতেন, এখন হাঁটেন ১৫ মাইল।
প্রায় তিন দশকের এই যাত্রায় অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হয়েছে বুশবির। তবে একটি উপলব্ধি তার মনে গভীর দাগ কেটেছে। 'পথে আমি যত মানুষের দেখা পেয়েছি, তাদের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশই চমৎকার মানুষ। পৃথিবীটা আসলে আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি দয়ালু ও সুন্দর,' বলেন তিনি।যখনই তিনি অসুস্থ হয়েছেন বা বিপদে পড়েছেন, অচেনা মানুষেরা দেবদূতের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। কখনো থাকার জায়গা, কখনো খাবার, আবার কখনো অর্থ বা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন। মানুষের এই ভালোবাসাই তাকে বাড়ি ফেরার পথে এগিয়ে নিচ্ছে।এত দীর্ঘ পথে শরীরও খুব একটা ভোগায়নি তাকে। বড় চোট পেয়েছেন মাত্র একবার। পড়ে গিয়ে হাতের কবজি কেটে গিয়েছিল, নিজেই সুঁই-সুতা দিয়ে তা সেলাই করেছিলেন। আর একবার পেরুতে পেটের পীড়ায় ভুগেছিলেন মারাত্মকভাবে। সেখানে এক চিকিৎসকের সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক লড়াইটা ছিল বেশি কঠিন। মাঝেমধ্যে একাকীত্ব জেঁকে ধরে তাকে। যাত্রাপথে দুই নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু যার ঘর নেই, পায়ের তলায় মাটি নেই, তার সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন। অদ্ভুত জীবনযাপনের কারণে দুটি সম্পর্কই ভেঙে গেছে। ২৫টি দেশ পার হয়ে এসেছেন, অথচ পায়ের অবস্থা এখনো চমৎকার। হাসতে হাসতে বুশবি বলেন, 'পায়ের যত্ন আসলে পা নিজেই নেয়।'সবাই বিশ্বভ্রমণে বের হবে, এমনটা তিনি আশা করেন না। তবে মানুষের জীবনে রোমাঞ্চ বা অ্যাডভেঞ্চার থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তাঁ মতে, 'পৃথিবীটা আসলে কেমন এবং এর মানুষগুলো কেমন—তা নিজের চোখে দেখা উচিত। এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর কিছু হতে পারে না।'বাড়ির যত কাছে আসছেন, বুশবির অনুভূতি তত মিশ্র হচ্ছে। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সকালে উঠে সামনে এগিয়ে যাওয়া। হঠাৎ সেই লক্ষ্য শেষ হয়ে যাবে। বুশবি বলেন, 'হঠাৎ থেমে যাওয়াটা সহজ হবে না। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা নিশ্চিতভাবেই কঠিন হবে।'
বাড়ি ফিরে বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে তার। তবে এই যাত্রায় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সাধ্যমতো সেই ভালোবাসা মানুষের মাঝে ফিরিয়ে দিতে চান তিনি।তরুণদের উদ্দেশে বুশবির শেষ কথা, 'পৃথিবী আপনাকে আগলে রাখবে, স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবে আর সামনে এগিয়ে নেবে। এই অভিজ্ঞতা সত্যিই বিস্ময়কর।'
কয়েক বছর প্রস্তুতির পর ১৯৯৮ সালে চিলির পান্তা অ্যারেনাসে এসে দাঁড়ান বুশবি। তার নিজ শহর ইংল্যান্ডের হাল থেকে পায়ে হাঁটা পথের দূরত্ব হিসেবে এটাই সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দূরবর্তী জায়গা। সামনে প্রায় ৩১ হাজার মাইলের পথ। বুশবি ভেবেছিলেন, হেঁটে বাড়ি ফিরতে তাঁর হয়তো ১২ বছরের মতো সময় লাগবে।কিন্তু সেই ১২ বছরের জায়গায় কেটে গেছে ২৭ বছর। ৫৬ বছর বয়সী বুশবি এখনো হাঁটছেন। থামেননি।এর মধ্যে তিনি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন পাতাগোনিয়া, আন্দিজ পর্বতমালা, মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো ও পুরো যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়া হয়ে এশিয়ার কিছু অংশও পার করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম, প্রতিকূল আর রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত কিছু এলাকাও তাকে পার হতে হয়েছে। কখনো মরুভূমি, কখনো গহিন জঙ্গল, আবার কখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের ভেতর দিয়ে অবিরাম হেঁটে চলেছেন এই অভিযাত্রী।শুরুতেই নিজের জন্য দুটো কঠিন নিয়ম ঠিক করে নিয়েছিলেন বুশবি। গত ২৭ বছরে একবারের জন্যও সেই নিয়ম ভাঙেননি। নিয়ম দুটি হলো—সামনে এগোতে কোনো যানবাহনের সাহায্য নেওয়া যাবে না এবং হেঁটে গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বাড়ি ফেরা যাবে না।
বুশবি বলেন, 'কোথাও আটকে গেলে সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়েছে।'তখনকার দিনে পথ চিনে নেওয়া আজকের মতো সহজ ছিল না। অভিযানের শুরুর দিকের কথা মনে করে বুশবি বলেন, 'সে সময় ভরসা ছিল কেবল কাগজের মানচিত্র, পেনসিল আর ক্যালকুলেটর।বুশবি তার এই অভিযানের নাম দিয়েছেন 'গলিয়াৎ এক্সপিডিশন'। ভেবেছিলেন ১২ বছরেই শেষ হবে, কিন্তু নানা বাধায় সময় লেগেছে অনেক বেশি। কখনো অর্থের অভাব, কখনো ভিসার জটিলতা। এর মধ্যে ছিল রাজনৈতিক বাধা আর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। কোভিড মহামারির কারণেও অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ইংল্যান্ডের হাল শহরে নিজের বাড়িতে পৌঁছাবেন।
বুশবি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপার ছিলেন। সেখান থেকেই চ্যালেঞ্জ নেওয়া আর দেশভ্রমণের নেশা চাপে তার মাথায়। তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনীতে থাকার সুবাদে দারুণ সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্যারাট্রুপার হিসেবে ফিটনেস, সহনশীলতা আর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি সেখান থেকেই রপ্ত হয়েছে।'
সেনাবাহিনীতে থাকার সময় কয়েকজন বন্ধুকে হারান তিনি। এই মৃত্যু তাকে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তিনি বুঝতে পারেন, জীবন খুব ছোট। তাই যতদিন বাঁচবেন, সেরাটা দিয়েই বাঁচতে হবে।এসব ভাবনা থেকেই ২৯ বছর বয়সে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বুশবি। যদিও শুরুর দিকে কেউ তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। পকেটে মাত্র ৫০০ ডলার নিয়ে তিনি পথে নেমেছিলেন।বুশবি বলেন, 'শুরুতে আমার কোনো সহায়সম্বল ছিল না।' রাত কাটাতেন রাস্তার পাশে তাঁবু টাঙিয়ে। কখনো কখনো স্থানীয় কেউ আমন্ত্রণ জানালে তাঁদের বাড়িতে থাকার সুযোগ মিলত। আমেরিকা মহাদেশ পার হওয়ার সময়টা ছিল আক্ষরিক অর্থেই 'বেঁচে থাকার লড়াই'। এমনকি ক্ষুধা মেটাতে রাস্তার পাশ থেকে খাবার কুড়িয়েও খেতে হয়েছে তাঁকে।
তবে ধীরে ধীরে দিন বদলাতে শুরু করে। পরিবার থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা আসে। তার এই অবিশ্বাস্য অভিযানের কথা ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এগিয়ে আসে বিভিন্ন কোম্পানি। ২০০৩ সালে কানাডায় পৌঁছানোর পর তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বই প্রকাশের চুক্তি হয়। পরে একটি প্রযোজনা সংস্থা তাঁর এই যাত্রা নিয়ে সিনেমা বানানোর আগ্রহও দেখায়।বুশবি বলেন, 'এই অভিযানের বড় শিক্ষা হলো, কেউ আসলে একা কিছু করতে পারে না। রাস্তায় হয়তো আমি একাই হাঁটছি, কিন্তু আমার পেছনে বিশাল এক সমর্থন কাজ করছে, যা আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং এগিয়ে যেতে সাহস জোগায়।'
সহায়তা জুটলেও পথের বাধা কম ছিল না। পানামা ও কলম্বিয়ার মাঝে অবস্থিত 'ডারিয়েন গ্যাপ'ও পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বিশ্বের অন্যতম দুর্গম ও ভয়ংকর জঙ্গল হিসেবে কুখ্যাতি আছে এই জায়গার।২০০৬ সালে বুশবি আলাস্কা ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী বেরিং প্রণালিতে পৌঁছান। এটি ছিল তার যাত্রাপথের মাঝামাঝি। শীতে এই প্রণালি পুরোপুরি জমে বরফ হয় না। বুশবি বলেন, 'বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল ভাঙা বরফ আর সমুদ্রের পানি। সামান্য পথ এগোতেও বরফের চাঁই বেয়ে পার হতে হয়েছে।'আলাস্কায় এক দুঃসাহসী সঙ্গীকে নিয়ে তিনি এই প্রণালি পাড়ি দেন। বুশবি বলেন, 'কেউ বিশ্বাস করেনি আমরা এটা পারব। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রথম প্রচেষ্টাতেই আমরা সফল হই, যা কেউ ভাবেনি।'রাশিয়ায় ঢুকেই আরেক বিপত্তি। ভুল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করায় আটক হন বুশবি। ৫৭ দিন তাঁকে আটকে রাখা হয়, মুখোমুখি হতে হয় বিচারের। অবশেষে রুশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে হাঁটার অনুমতি দেয়। বুশবি বলেন, 'পুরো ব্যাপারটাই ছিল এক অলৌকিক ঘটনার মতো।'
দীর্ঘ এই যাত্রায় বাধার কোনো শেষ ছিল না। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় স্পনসররা সরে দাঁড়ালে থমকে যায় তার পথচলা। এরপর ২০১৩ সালে পুরোনো ভুলের জের ধরে রাশিয়া তাকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন বুশবি। নিষেধাজ্ঞা কাটাতে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে হেঁটে ওয়াশিংটনে রুশ দূতাবাসে গিয়ে আবেদন করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।২০২৪ সালের আগস্টে যাত্রাপথে দ্বিতীয়বারের মতো বড় জলাধারের মুখোমুখি হন বুশবি। রাজনৈতিক কারণে ইরান বা রাশিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই কাজাখস্তান থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত কাস্পিয়ান সাগর সাঁতরে পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। টানা ৩১ দিন ধরে তিনি সাঁতরেছেন। রাতে ঘুমাতেন সঙ্গে থাকা সহায়তাকারী নৌকায়।
তুরস্ক হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেন বুশবি। সম্প্রতি তিনি হাঙ্গেরিতে পৌঁছেছেন। নিজের শহর হাল থেকে আর মাত্র ৯৩২ মাইল (প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার) দূরে আছেন তিনি। বুশবি বলেন, 'পুরো পথটা আমাকে হেঁটে বা সাঁতরে পার হতে হয়েছে। যেখানেই থেমেছি, ফিরে এসে ঠিক সেখান থেকেই আবার যাত্রা শুরু করেছি।'ভিসার নিয়মের কারণে ইউরোপে একটানা ৯০ দিনের বেশি থাকতে পারেন না তিনি। তাই বাধ্য হয়ে বিরতি নিয়ে মেক্সিকোতে গিয়ে বিশ্রাম নেন। সময় হলে আবার ফিরে এসে সেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে হাঁটা শুরু করেন। তবে বয়সের কারণে হাঁটার গতি কিছুটা কমেছে। আগে দিনে ১৯ মাইল হাঁটতেন, এখন হাঁটেন ১৫ মাইল।
প্রায় তিন দশকের এই যাত্রায় অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হয়েছে বুশবির। তবে একটি উপলব্ধি তার মনে গভীর দাগ কেটেছে। 'পথে আমি যত মানুষের দেখা পেয়েছি, তাদের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশই চমৎকার মানুষ। পৃথিবীটা আসলে আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি দয়ালু ও সুন্দর,' বলেন তিনি।যখনই তিনি অসুস্থ হয়েছেন বা বিপদে পড়েছেন, অচেনা মানুষেরা দেবদূতের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। কখনো থাকার জায়গা, কখনো খাবার, আবার কখনো অর্থ বা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন। মানুষের এই ভালোবাসাই তাকে বাড়ি ফেরার পথে এগিয়ে নিচ্ছে।এত দীর্ঘ পথে শরীরও খুব একটা ভোগায়নি তাকে। বড় চোট পেয়েছেন মাত্র একবার। পড়ে গিয়ে হাতের কবজি কেটে গিয়েছিল, নিজেই সুঁই-সুতা দিয়ে তা সেলাই করেছিলেন। আর একবার পেরুতে পেটের পীড়ায় ভুগেছিলেন মারাত্মকভাবে। সেখানে এক চিকিৎসকের সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক লড়াইটা ছিল বেশি কঠিন। মাঝেমধ্যে একাকীত্ব জেঁকে ধরে তাকে। যাত্রাপথে দুই নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু যার ঘর নেই, পায়ের তলায় মাটি নেই, তার সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন। অদ্ভুত জীবনযাপনের কারণে দুটি সম্পর্কই ভেঙে গেছে। ২৫টি দেশ পার হয়ে এসেছেন, অথচ পায়ের অবস্থা এখনো চমৎকার। হাসতে হাসতে বুশবি বলেন, 'পায়ের যত্ন আসলে পা নিজেই নেয়।'সবাই বিশ্বভ্রমণে বের হবে, এমনটা তিনি আশা করেন না। তবে মানুষের জীবনে রোমাঞ্চ বা অ্যাডভেঞ্চার থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তাঁ মতে, 'পৃথিবীটা আসলে কেমন এবং এর মানুষগুলো কেমন—তা নিজের চোখে দেখা উচিত। এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর কিছু হতে পারে না।'বাড়ির যত কাছে আসছেন, বুশবির অনুভূতি তত মিশ্র হচ্ছে। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সকালে উঠে সামনে এগিয়ে যাওয়া। হঠাৎ সেই লক্ষ্য শেষ হয়ে যাবে। বুশবি বলেন, 'হঠাৎ থেমে যাওয়াটা সহজ হবে না। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা নিশ্চিতভাবেই কঠিন হবে।'
বাড়ি ফিরে বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে তার। তবে এই যাত্রায় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সাধ্যমতো সেই ভালোবাসা মানুষের মাঝে ফিরিয়ে দিতে চান তিনি।তরুণদের উদ্দেশে বুশবির শেষ কথা, 'পৃথিবী আপনাকে আগলে রাখবে, স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবে আর সামনে এগিয়ে নেবে। এই অভিজ্ঞতা সত্যিই বিস্ময়কর।'